মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

এবং তারপর, ২০/০১/২০২০ - "মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?"

পিঠালা সো মজলিশ গয়ি, তানসেন সো রাগ
হাসিবো, রামিবো, বলিবো - গয়ো বীরবরা সাথ।' 



সাল ১৫৮৬। এপ্রিল ২৩। প্রয়াত হলেন মিঁয়া তানসেন। শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তাঁর প্রয়ানের তিথি নিয়ে আজও সঠিক হদিশ পাওয়া যায়না। যেমন জানা যায়না তার সঠিক জন্মতিথিও। এমনকি, তানসেন কি ভাবে প্রয়াত হলেন সে নিয়েও রয়েছে বহু মতভেদ। 
কেউ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গাইতে গাইতে গলায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষত বিষিয়ে গিয়েই...অনেকে বলেন, রাগ বাচস্পতি গাইতে গিয়ে শ্বাস আটকে মারা যান তিনি...আবার অনেকের মতে, তার মৃত্যুর কারণ স্বয়ং বাদশা আকবর। শেষোক্ত কারণটিই বহুল চর্চিত।  


রাগ দীপক শোনার জন্য ছেলেমানুষী বায়না ধরে ছিলেন বাদশা। বড় ভয়ানক সে রাগ। সে রাগের সঠিক প্রয়োগে শুধু প্রদীপের জ্বলে ওঠা নয়, খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পুরোমাত্রায়। তাই প্রথমে অরাজি হলেও, পরে নিজের অন্নদাতা জালালুদ্দিনের আবদার রাখতে গিয়ে দীপক রাগের প্রভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তানসেন। মেয়ে সরস্বতী (মতান্তরে সংগীতাচার্য স্বামী হরিদাসজীর ছাত্রী রূপা) বাপের নির্দেশে মেঘ মলহার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই...কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরী হয়ে গেছিল! আজ সে সব কিংবদন্তি। 
কারণ যাইহোক, প্রায় আশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন আকবরের 'নবরত্নসভা'র অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেন। সেই শোকে পাথর হয়ে গেলেন আকবর। একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হল তামাম মুঘল রিয়াসতে। তানসেনের 'জনাযা'য় গোটা আগ্রার পাশাপাশি শামিল হলেন শাহেনশাহ'ও। কিন্তু এরপরেই শুরু হল সেই বিতর্কিত অধ্যায়। 


তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ। বেঁকে বসলেন হিন্দু সমাজের একশ্রেণির মাতব্বরেরা। তাঁরা ঘোষণা করলেন, তানসেন হিন্দুর ঘরের ছেলে। নাম রামতনু মিশ্র, পিতা মুকুন্দ মিশ্র (মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষন ও সুগায়ক। জনৈকা মুসলিম রমনীর (তানসেনের স্ত্রী হুসেইনি বেগম) চক্করে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেও, তার শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তার শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্রমতেই হওয়া উচিত। 
কিন্তু এ তত্ত্ব মানতে নারাজ ইমাম-মৌলভীরা। তাঁরা বললেন, আগে কি ছিলেন তা বড় কথা নয়, ধর্ম বদল করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন। ছিলেন পাঁচ রোজের 'নামাজি'। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা। তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে রীতিমত শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ, প্রবল তর্কাতর্কি। 

বলাবাহুল্য, বেকায়দায় পড়লেন আকবর। কোন পক্ষকেই চটাতে চাননা তিনি। একেই দীর্ঘদিনের সুহৃদ তানসেনের মৃত্যুতে তিনি শোকাহত, তার উপরে এমন জটিল পরিস্থিতি, এহেন অবস্থায় খোদ আকবর'ও বিপর্যস্ত। তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে দাঙ্গা বেঁঁধে যাওয়ার উপক্রম। এমন সময়ে আসরে নামলেন তানসেনের মেয়ে সরস্বতী। বলে রাখা ভাল, তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান - হামীরসেন, সুরটসেন, তানরস খান, সরস্বতী দেবী ও বিলাস খান। এরা প্রত্যেকেই উচ্চমানের গায়ক ও বীনাবাদক। পাঁচ সন্তানের মধ্যে মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন তানসেন। সেই সরস্বতী বললেন, তার মৃত্যুর পর যে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা ঠিকই আঁচ করেছিলেন তানসেন। তাই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা নিয়ে দিয়ে গেছেন বিস্ময়কর নির্দেশ। আর সেই নির্দেশ হল - গান। যে গায়ক তার গানের প্রভাবে তানসেনের মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন, তার ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে আকবরের 'নবরত্নে'র অন্যতম এই 'রত্ন'টির। অর্থাৎ কিনা জীবনের শেষ অধ্যায়টির বিচার হবে সঙ্গীত দিয়ে। একেই বলে 'পোয়েটিক' থুড়ি 'মিউজিকাল জাস্টিস'। 
অবাক হলেন আকবর। এ কি অসম্ভব কাজ! গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণের সঞ্চার কখনও সম্ভব নাকি? আশ্বস্ত করলেন তানসেন দুহিতা - হ্যাঁ সম্ভব! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে রয়েছে সে গুণ, দরকার আধ্যাত্মিক সাধনা, সুরজ্ঞান ও আন্তরিক পরিবেশনের। বলাবাহুল্য, প্রস্তাবের সার্থকতা নিয়ে সন্দিহান হলেও অসম্ভব এই প্রস্তাবটি শেষমেশ মনে ধরে আকবরের। অবাক কাণ্ড, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাতব্বরেরাও একমত হলেন এই প্রস্তাবে। সংরক্ষিত করা হল তানসেনের মরদেহ। তারপর শুরু হল সেই রুদ্ধশ্বাস গানের লড়াই। মৃতসঞ্জীবনী সুরসুধার সন্ধানে, যা এক কথায় ছিল অসাধ্যসাধন। কারণ, তানসেনের পরবর্তী এমন কোন গায়ক সে সময় ছিল না তামাম হিন্দুস্থানে যে কিনা এমনই ঐশ্বরিক ক্ষমতাধারী যার সুরের জাদুতে মৃতের শরীরেও প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারে। তবু সে সময় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মূহুর্তের স্বাক্ষী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই শুরু হল গান।     
     

তিনদিন, তিনরাত দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত। সম্রাট আকবরের আমন্ত্রণে সারাদেশ থেকে আগত সেরা গায়করা ভিড় জমিয়েছেন আগ্রার দরবারে। দিনরাত ধরে পালা করে চলছে ওস্তাদি গান। ওদিকে ফুল, আতর, বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে তানসেনের মরদেহ। মনে হচ্ছে যেন পরম নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন, এক্ষুনি জেগে উঠে তানপুরার তার বেঁধে রেওয়াজে বসবেন তার গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট 'বৃন্দাবনী সারঙ্গ' রাগে। ওদিকে গান গেয়ে গেয়ে জেরবার দেশের তাবড় তাবড় গওয়াইয়ারা। তিনদিন ধরে সুরের বন্যা বয়ে গেল রাজ দরবারে, অথচ নিস্পন্দ তানসেন। তার মৃত শরীরে স্পন্দনের কোন লক্ষন নেই। এত কিছু করেও কি তবে সব আয়োজন ব্যার্থ হতে চলেছে? এমনকি কোন গায়ক সত্যিই নেই ভূভারতে, যে কিনা তানসেনের সমান ওজস্বী? নেই কি তানসেনের সমকক্ষ কোন সুরসাধক যে কিনা এই অসাধ্যসাধন করতে পারে? বলাবাহুল্য হতাশ হয়ে পড়লেন আকবর।  


এপ্রিল ২৬। সাল ১৫৮৬। ভোরের আলো ফুটতে তখনও দেরী। একটু একটু করে সরছে রাতের পর্দা। ধীর পায়ে রাজদরবারে এসে দাঁড়ালেন এক দীন ফকির। বললেন, তিনি একবারটি চেষ্টা করতে চান। চালচূলোহীন সেই ফকিরের কথা শুনে ত' হেসে কুটিপাটি সভাসদরা। তামাম হিন্দুস্তানের নামজাদা ওস্তাদেরা যেখানে ফেল করেছেন এই ফকির সেখানে কি চমৎকার দেখাবেন? ফকির কিন্তু অনড়। শেষ চেষ্টা করে দেখতে তিনি যেন মরীয়া। তার উজ্জ্বল দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সায় দিলেন আকবর। তানসেনের পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন তার গান। আর কি আশ্চর্য! মূহুর্তে যেন পাল্টে গেল গোটা পরিবেশ। অজানা সেই রাগের অপার্থিব সুরের অদ্ভুত সেই মায়াজালে আচ্ছন্ন হলেন সকলে। ভোরবেলার সেই রাগের এমনই মাধূর্য, যেন সকাল এরজন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল। সেই রাগ কেউ কখনো শোনেনি। কেউ কখনও ভাবেনি এমনও গান হয়। কি গায়কি, কি তালিম, কি সুর - প্রতিটি চলনে সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত এমনকি যেন হারিয়ে ফেলেছেন মুখের ভাষা। এমন সময় দেখা গেল সেই অদ্ভুত দৃশ্য! অজ্ঞাত সেই ফকিরের গানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে রাজসভায় শায়িত মিঁয়া তানসেনের নিস্পন্দ শরীরে। ফকির ভাবলেশহীন, তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন। যেন পরম করুনাময় ঈশ্বরের সাধনায় লীন হয়ে গেছে তার সকল স্বত্তা, বোধ, জাগরণ। এরপর অবলীলাক্রমে যখন একটি অসাধারণ গমক নিলেন সেই ফকির, সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন মৃত তানসেনের ডান হাতটি কাঁপছে। কালক্রমে দেখা গেল সেই অজ্ঞাত গায়কের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে তানসেনের ডানহাত। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন সময় থমকে গেল। তারপর সব শেষ। 
ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায়। সবাই আপ্লুত চোখে তখন সেই ফকিরের দিকে তাকিয়ে। গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির। অদ্ভুত প্রশান্তি তার মুখে। সকলের মুখে তখন একটাই প্রশ্ন - কে এই ফকির? ইনি ত কোনও সাধারণ মানুষ নন! খোদ বাদশাহ আকবর পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নিজের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি সেই ফকির। পরে উপস্থিত সকলের একান্ত অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি। 
তিনি বিলাস খান। তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান। অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়ে ছিলেন তিনি। সেদিন তার গাওয়া সেই রাগ তার নিজস্ব রচনা। নাম 'বিলাসখানি টোড়ি'।        
সেদিন দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেই ফকিরকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন 'দীন ই ইলাহী'। বিলাস খান জানিয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর যেন তাকেও তারা পিতার পাশে স্থান দেয়া হয়। আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র।    

শাগরেদ'দের কাছে প্রায়ই এই গল্প শোনাতেন বড়ে গোলাম। শ্রীকৃষ্ণ রতনঝনকর জানিয়েছেন, এই গল্প শোনাতে শোনাতে নাকি আপ্লুত হয়ে পড়তেন বড় খান সাহেব। চোখে জল এনে কপাল চাপড়ে বলতেন, "হায়! হায়! কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব  মানুষগুলো।" বলতেন, আর কি কখনও এমন গান হবে! আর কে স্পর্শ করবে সেই সাধনমার্গ? খুব আক্ষেপ করে বলতেন - এমন মৃত্যুই বা নসিব হয় কতজনের।

Comments

Popular posts from this blog

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

খাঁচার মধ্যে ভয়ে কাঁটা, বলির পাঁঠা