মা ও তার সন্তানের গল্প

এবং তারপর, ২২/১১/২০১৯ :  একটি মা ও তার সন্তানের গল্প, তবে কিনা এটি গল্প নয়, ঘোর বাস্তব। পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুরের কাছে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনা। এক ২২ বছরের তরুণী, সন্তানসম্ভবা অবস্থায় জানতে পারল যে তার স্বামী আর তাকে রাখবে না;  দেহের মধ্যে তিল তিল করে বাড়ছে আর একজন। গত বছরই বিয়ে হয়েছিল তাদের, এর মধ্যেই তার স্বামীর আর তাকে ভাল লাগছে না, এবার কি হবে ? পেটের  বাচ্ছাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে ? আকাশ ভেঙে পড়ল তরুণীর মাথায়।

দেশ

সে নিজে শিক্ষিত নয়, যে কোথাও চাকরি নেবে ?  এমন কিছু সে কাজও  জানে না, যে অন্য্ কোনো কাজ করে দিন গুজরান করবে ! তাছাড়া অন্ত:সত্তা হওয়ায় তার শারীরিক অবস্থায় তো তেমন ভাল নয়; চিরকালই সে একটু ছিপছিপে গড়নের। তরুণী ভাবতে থাকে, এবার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে ? কার কাছে গিয়ে সাহায্য পাবে ? কি খাবে ? বাচ্ছাকেই বা কি খাওয়াবে ? এতদিন যাকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে ভেবেছিল, যাকে একমাত্র আশ্রয় হিসেবে ভেবেছিল, এক হঠাৎ এবং কঠোর নিদানে  সে চলে গেছে যেন কত কত দূর; তাকে যে বোঝাবার চেষ্টা করেনি ঐ গৃহবধূ তা নয়, কিন্তু স্বামীর ঐ এক কথা, তাকে আর ভাল লাগছে না;


তরুণী ভাবতে থাকে, শুধুই ভাবতে থাকে, কি ভয়ঙ্কর দিন আসতে  চলেছে তার জীবনে । কয়েকদিন আগেও তাদের জীবনে যে আসছে, তাকে নিয়ে সবে  মাত্র স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল সে, আর স্বামীর এক ফরমানে তার সমস্ত স্বপ্ন যে শুধুই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তাই নয়, এখন এমন একটা অবস্থা, যে মা  তার গর্ভে থাকা শিশুর প্রাণ রক্ষা করতে পারবে  কিনা সেটাই চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামী আর ঠিকমত খেতে দেয় না, স্বল্পাহারে তবুও বাড়ির সব কাজ করে কোনো রকমে গর্ভের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল তরুণী মা; তার যে খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হচ্ছে না, সেটা চোখ এড়ায়নি প্রতিবেশী মহিলাদের। তাই মাঝে মাঝে কিছু করুণা  জুটে  যেত কপালে। কিছু খাবার জুটত তার গর্ভের অংকুরের জন্যে।


ইদানিং তরুণীর শরীর  আরও খারাপ হতে থাকল, পড়শিদের সাহায্যেই সে ভর্তি হল হাসপাতালে। যার ঔরসে তার দেহে একজন এতখানি বেড়ে উঠেছে , সেই স্বামীর কিন্তু কোনো পাত্তা নেই, একবারের জন্যেও সে হাসপাতালে আসেনি তার স্ত্রীর  খোঁজ নিতে। একটা চাপা কান্না, একরাশ অভিমান যেন হৃৎপিন্ডটাকে বন্ধ করে দিতে চায়, কিন্তু তার হৃৎপিন্ডটা বন্ধ হলে তো চলবে না, তাহলে যে আর একজনের হৃৎপিন্ডটাও বন্ধ হয়ে যাবে! আর ভাবতে পারেনা অল্পবয়সী এই মা; হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিনদিন পর এক বার্তা এল তার কাছে তার স্বামীর তরফ থেকে। দুটো লোক এসে কি যেন হাবিজাবি কাগজে তার টিপছাপ নিয়ে গেল, আর বলে গেল আজ থেকে তার স্বামীর সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই; শরীর  আর মন কোনোটাই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না, তাই চোখ থেকে  এক ফোঁটা  জলও  বেরিয়ে আসেনি তার, সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে পেটের  মধ্যে একজন দস্যিপনা করে চলেছে, খুব ব্যাথা শুরু হয়, এরপর আর  কিছু মনে নেই তার, যেন অতল  গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন  হয়ে পারে সে;
ঘুম ভাঙেসদ্য  পৃথিবীর আলো  দেখা একজনের অতল স্পর্শী  কান্নার আওয়াজে, মা বুঝতে পারে যার আসার জন্যে এত কষ্ট  করে একদিন একদিন করে সে দিন গুনছিল, যাকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার জন্যে সে এতদিন ধরে সব কিছু ভুলে যেতে চেয়েছিল, সে এসেছে। চোখ খুলে  তাকে অবাক হয়ে দেখে তরুণী, দেখে দেবদূতের মত ছোট্ট একটা ফুলের পাপড়ি হাত বাড়িয়ে তার দিকেই আসতে  চাইছে, নার্স দিদিমনির দুই হাতের আগল ছাড়িয়ে। এই প্রথম তরুণী বুঝতে পারল, এখন সে আর একা  নয়, আজ থেকে সে দুজন। তার দুই শরীর,  দুই আত্মা, দুই ক্ষিধে। চোখের কাছটা কেমন যেন ভিজে ভিজে লাগল তার;

শিশু সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ফিরে এল সে তার প্রাক্তন স্বামীর বাড়িতে, কোলে করে কাকে নিয়ে সে এসেছে, তা দেখানোর জন্যে। কিন্তু তার স্বামী তাকে চিনতেই অস্বীকার করল;
প্রতিবেশী মহিলাদের চাপে  অবশ্য দুই সপ্তাহ অনুমতি মিলল সেখানে থাকার, কিন্তু খাবার পাওয়া যাবে না; শরীর তার খুবই  দুর্বল, তবু দুই সপ্তাহ সময় তার কাছে যেন অমূল্য মনে হল । কিন্তু সে নিজে বা তার শিশুকে  না খাইয়ে  কতদিন চলবে ? এই প্রশ্নটাই কুরে কুরে খাচ্ছিল তাকে। প্রতিবেশী মহিলাদের সহায়তায় সারাদিনে সামান্য কিছু আহার জোটে। এভাবেই পেরিয়ে গেল এক সপ্তাহ। বাচ্ছা খালি কাঁদে, খালি কাঁদে,  আর যত সে কাঁদে তার বাপ্ তত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তাকে বাচ্ছা সমেত চলে যেতে বলে; গ্রামের পাঁচজন বাড়িতে এসে বোঝাতে চাইল তার প্রাক্তন স্বামীকে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না; দিন এগিয়ে আসছে এবার এই ভিটে থেকেও তাকে চলে যেতে হবে, কিন্তু কোথায় যে সে যাবে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছিল না; সব থেকে আগে তো খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, তার আর তার বাচ্ছার। গ্রামের মোড়লের বউ এসে বুদ্ধি দিল, আগে বাচ্চা সমেত কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, তার পর কিছু একটা কাজ করে আহারের ব্যবস্থা করতে হবে; কি কাজ করবে সে ? সেভাবে তো কিছু সে শেখেইনি ! লোকের বাড়িতে কাজ করতে গেলে অতটুকু বাচ্ছাকে  কার কাছে বিশ্বাস করে রেখে দিয়ে যাবে ? মোড়লের বউ  বলল সরকারি প্রকল্পে সেলাই শিখে নিতে। সে ভাবল সেটা হতে পারে, কিন্তু সেলাই শিখে নেওয়া অবধি কি খাবে সে নিজে আর কিই খাওয়াবে তার বাচ্ছাকে ?
দুদিন বাদে প্রাক্তন স্বামীর ঘরের কাছেই একটা ভাঙা কুঁড়ে ঘর জুটল মাসে এক প্রতিবেশীর দয়ায় । কিন্তু খাবার আসবে কোথা থেকে ? এদিকে বাচ্ছাকে খাবার দিতেও পারেনি দুদিন হল, নিজেতো শুধু টিউবকালের জল খেয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে। না: আর সে ভাবতে পারে না ; বাচ্ছার মুখের দিকে তাকাতেও  আর পারে  না অসহায় মা,  মা ও বাচ্ছা এভাবেই  লড়াই করে চলল ক্ষুধার সাথে। 
চারদিকেই যেন ঘন অন্ধকার, কোথাও কোনো আশার  আলো নেই.; এমন সময় মোড়লের বউ এসে যে প্রস্তাব তাকে দিল, সেটা  মেনে নিতে তার মন এতটুকুও সায় দেয় নি, কিন্তু সায় দিয়েছিল তার শরীর, সে কিছু একটা খেতে চায়, সে তার নয়নের মনিকে আর না খাইয়ে রাখতে পারছে না; 
পরের দিন সকালে একটি লোক তাঁর বউকে নিয়ে এল তার ভাঙা কুটিরে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাচ্ছাকে নিয়ে চলে গেল, বাচ্চা তখন ক্ষিদের জ্বালায় ঘুমাচ্ছিল। বুকে পাথর চাপা রেখে সবকিছু যেন নাটকের পালার মত দেখে গেল আশায় এক মা; শেষবারের মত  চুম্বন করে তাকে তার নতুন মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল তরুণী মা; পনেরো হাজার টাকা তার কাছে অনেক, কিন্তু বাবুসোনা আর নেই, তার কোল  খালি করে দিয়ে চলে গেছে নতুন মায়ের কাছে, তার মধ্যেই মনটা একটু ভাল লাগছে, তবু তো তার ছোট্ট সোনা কিছু খেতে পাবে, তার কান্না থামবে, নাই বা সে মনে রাখল এই কুড়িটা দিন তাকে আর এক মা আগলে রেখেছিল, হাতে টাকা পেয়েও একটা মুড়ির দানাও মুখে তুলতে পারেনি সে;  বিকেলের দিকে প্রতিবেশী মহিলারা কেউ কেউ বাচ্ছার কথা জিজ্ঞাসা করলেও সে মুখে কুলুপ এঁটেছিল, কেন বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ আসছে না, এই সব প্রশ্নবানে সে জর্জরিত হয়ে উঠছিল, এমন সময় হঠাৎ এল পুলিশ, এসে তাকে নিয়ে গেল থানায়, চলল টানা জেরা। সে সব কিছু খুলে বলতে বাধ্য হল; হাউ হাউ করে কেঁদে  সব দু:খ যেন উজাড় করে দিতে চেয়েছিল। ঘন্টা দুই পর ঐ দম্পতিকেও বাচ্ছা সমেত ধরে নিয়ে এল পুলিশ, সে দেখল তার বাবুসোনা চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে নতুন মায়ের কোলে; সে তার নতুন মায়ের কাছে শুনল বাবুসোনা  দুধ খেয়েছে। খুব শান্তি পাচ্ছিল সে; এরপর আদালতে হাজিরা, তারপর সেখান থেকে জেল-হাজত ; বাচ্ছাকে আপাতত মায়ের কাছেই রেখে দেওয়া হয়েছে, সে ভাবল এই বেশ ! তার নিজের আর বাচ্ছার মুখে দুবেলা কিছু খাবার তো পড়বে  !

এই ঘটনা গতকালের, আজকের সংবাদ পত্রে হয়ত অনেকেই পড়েছেন সেই খবর; ইডেনে আজ থেকে শুরু হতে চলেছে ভারত বনাম বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ, রাজনীতির নেতারা হয়ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গোটা পশ্চিমবঙ্গ, হয়ত উন্নয়নের নতুন সূর্য উঠেছে সোনার বাংলায়, হাজারো খবরের ভিড়ে হারিয়ে গেছে এক অসহায় মা ও তার সন্তানের ছোট্ট করুন কাহিনী। আসল অপরাধী গ্রেপ্তার হয় নি, আর মাত্র ২০ দিন আগে যে এই পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছে তাকেই বিনা অপরাধে হাজতে বাস করতে হচ্ছে, তাতে কি ? মা তার আদরের ধনকে বুকে জড়িয়ে রেখে দুবেলা খেতে তো দিতে পারবে ! সেই নিরাপত্তাটুকুতো আছে ! আপাতত ১৪ দিনের জেল হেফাজতে  রয়েছে মা ও তার ২০ দিনের শিশু , বাচ্চা বিক্রি করার ১৫ হাজার টাকা সে ফিরিয়ে দিয়েছে। 


Comments

Popular posts from this blog

মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান এতো খারাপ কেন ? (পর্ব - ১)