সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান এতো খারাপ কেন ? (পর্ব - ১)

বিশেষ নিবন্ধ

এবং তারপর (বাংলা), ০৬/০৫/২০২০ : প্যারিস ভিত্তিক অসরকারী সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’ (আরএসএফ), বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাংবাদিকদের স্বাধীনতার মূল্যায়ন করে তার সর্বশেষ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক প্রকাশ করেছে। এই সূচকে বিশ্বের বৃহত্তম, সবথেকে প্রাণবন্ত এবং মুক্ত গণতন্ত্রের দেশ, যেখানে বহুজাতিক সমাজব্যবস্থা বিরাজমান౼সেই ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২। গত বছরের থেকে যা ২ ধাপ নীচে।    
 আরএসএফ-এর মূল্যায়ন অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান এতো খারাপ কেন ? এখানেই আরএসএফ –এর গণতন্ত্রের সম্পর্কে ধারণা এবং যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে। 
আরএসএফ –এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা যে স্বাধীনতা উপভোগ করেন, সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে, একদল বিশেষজ্ঞের তৈরি করা বিস্তারিত প্রশ্নাবলী থেকে। সংশ্লিষ্ট সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হেনস্থা এবং নিপীড়নের বিষয়ে সংগৃহীত বিপুল তথ্যের মূল্যায়ন করা হয়েছে। যে ৮৭টি প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, বহুত্ববাদ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমজগৎ-এর পরিবেশ এবং আত্মমূল্যায়ন, আইনী কাঠামো, স্বচ্ছতা আর সংবাদ ও তথ্য উপস্থাপনার পরিকাঠামোর গুণমান। অনলাইনের মাধ্যমে আরএসএফ, বিশ্বের ১৮টি অসরকারী সংগঠন এবং ১৫০জন সংবাদদাতার কাছে প্রশ্নাবলী পাঠায়। একই সঙ্গে এই সংবাদদাতারা যে সব গবেষক, বিচারক, মানবাধিকার কর্মীকে নির্বাচন করবেন, তাদের কাছেও এই প্রশ্নাবলী পাঠানো হয়। কোনো একটি দেশের উত্তরদাতাদের মধ্যে এক দশমাংশ থাকেন, সেই দেশে কাজ করা বিদেশী সাংবাদিকরা।     
 আর এখানেই বড় একটি ফাঁক থেকে গেছে। ভারতের মতো ১৩০ কোটি  জনসংখ্যার দেশের সমীক্ষার জন্য নমুনার পরিমাণ যথেষ্ট কম এবং যে সমস্ত অংশগ্রহণকারীদের বাছাই করা হয়, তাঁরা খুব একটা পরিচিত মুখ নন। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনা করবো।   

 প্রথমত, একজন ভাবতেই পারেন যে, সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশে অপরিহার্য শর্ত হল, মুক্ত সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই সূচকের কাছে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যেমন প্রজাতান্ত্রিক সরকার, বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবিধানের দৃঢ় অঙ্গীকার, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ প্রদান, ধর্ম এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার পৃথকীকরণ, আইনের চোখে সকলের সমান মৌলিক অধিকার এবং সাম্যের রক্ষাকবচ, লিঙ্গ সমতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দানের মতো গণতন্ত্রের মূল বিষয়গুলি এই সূচকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনে হয় যেন আরএসএফ –এর কাছে কোনো দেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিচার করার সময় এগুলির কোনো ভিত্তি নেই। আর এটিই সবথেকে বড় ত্রুটি।   
 স্পষ্টতই আমরা দেখতে পাই, কিছু কিছু দেশ যাদের গণতান্ত্রিক কোনো পরিকাঠামো নেই, তারাও ভারতের থেকে উপরে রয়েছে। তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হল।
 আরএসএফ –এর সূচক অনুসারে ভারতের স্থান যেখানে ১৪২, বুরকিনা ফাসো সেখানে ৩৬ নম্বর স্থানে রয়েছে। কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, মানুষ পাচার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বুরকিনা ফাসোতে দাস ব্যবস্থা এখনও রয়েছে। সে দেশের শিশুরা এর সব থেকে বেশি শিকার। ঐ প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়েছে, আরবের দাস ব্যবসার সময় থেকে এই দেশটিতে দাসপ্রথা একটি চিরস্থায়ী প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দাসত্ব সূচক অনুসারে ২০১৮ সালে প্রায় ৮২,০০০ মানুষ এই দেশে ‘আধুনিক দাস ব্যবস্থা’-র শিকার।   
 আরএসএফ –এর সূচকে মালদ্বীপের স্থান ৭৯। সেদেশের সংবিধান অনুসারে মালদ্বীপের ধর্ম হল ইসলাম এবং ইসলামের মতবাদের বিরুদ্ধে কোনো আইন বিবেচিত হবে না। সংবিধানের ৯এর(ঘ) ধারায় অনুসারে বলা হয়েছে, যাঁরা মুসলমান নন, তারা কেউ মালদ্বীপের নাগরিক হতে পারবেন না। 
 আরবের ইসলামিক রাষ্ট্র ওমানের স্থান এই সূচক অনুসারে ১৩৫। ওমানের সংবিধান অনুসারে দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ইসলামিক শরিয়াতি আইন  হল আইন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। সেদেশের শাসক হলেন সুলতান। সাঈদ তুর্কী বিন সৈয়দ  বিন সুলতানের পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই একমাত্র দেশ শাসনের অধিকারী। যাঁকেই বাছাই করা হবে, তিনি হবেন একজন মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক, যুক্তিবাদী এবং ওমানী মুসলমান বাবা-মায়ের বৈধ পুত্র।     
অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, এই দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রজাতান্ত্রিক দেশ নয়। দেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধানকে মুসলমান পুরুষ  হতে হবে।
কমোরোস, এই সূচকে ৭৫ নম্বর স্থানে রয়েছে। কমোরোসের সংবিধানে বলা আছে, সে দেশের জনগণ ইসলামের প্রতি আস্থাশীল এবং দেশের শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনীতির চিরস্থায়ী অনুপ্রেরণার ভিত্তি হল ইসলাম ধর্ম। 
 চলুন, আমরা এখন এমন  কিছু দেশের কথা আলোচনা করি, যাদের ভিত্তি হল খ্রীষ্টধর্ম। সূচকে আর্জেন্টিনা রয়েছে, ৬৪ নম্বর স্থানে। দেশটির সংবিধানে বলা আছে যে ফেডেরাল সরকার, রোমান ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক ধর্মকে সমর্থন করে।   

আরএসএফ –এর সূচক অনুযায়ী, ৮১ নম্বর স্থানে থাকা মাল্টার সংবিধানে বলা আছে, সে দেশের ধর্ম হল রোমান ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক। সংবিধান অনুসারে রোমান ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক গীর্জার দায়িত্ব এবং কর্তব্য হল, কোন নীতি সঠিক এবং কোন নীতি ভুল, সেবিষয়ে সকলকে শিক্ষাদান করতে হবে। অর্থাৎ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্ত স্কুলে রোমান ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হয়।   
আরএসএফ –এর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। বলা হয়েছে, এই দেশটিতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সব থেকে বেশি। নরওয়ের সংবিধানে বলা আছে, সে দেশের সরকারের ক্ষমতা সীমিত এবং দেশটি রাজতন্ত্র অনুসরণ করে চলবে। সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটি খ্রীষ্টান এবং মানবতাবাদী ঐতিহ্য মেনে চলবে। নরওয়ের রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাজাকে সবসময় ইভানগেলিক্যাল – লুথারান ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে। রাজা হলেন পবিত্র। তাঁকে কোনোভাবে দোষারোপ বা বিচারপ্রক্রিয়ায় আনা যাবে না। অন্যভাবে বলা যায়, দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ বা প্রজাতান্ত্রিক দেশ নয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায়, যেমন বলা আছে, আইনের চোখে সকলে সমান এবং আইন, সকলের ওপর সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে౼নরওয়ের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সেই মূল ভিত্তিটিই প্রযোজ্য নয়।   
তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা ডেনমার্কের সংবিধানে বলা আছে, ‘চার্চ অফ ডেনমার্ক’ হল ইভানগেলিক্যাল – লুথারান চার্চ। রাষ্ট্র এই ব্যবস্থা মেনে চলবে।  পবিত্র বাইবেল অনুসারে জার্মান ধর্মগুরু, মার্টিন লুথারের শিক্ষা অনুসারে সে দেশে বিভিন্ন বই লেখা হয়েছে। ডেনমার্কের অন্যতম কর্তব্য হল, চার্চ অফ ডেনমার্ককে আর্থিক এবং অন্য নানাভাবে সাহায্য করা। 
গ্রীস, এই তালিকার ৬৫ নম্বর স্থানে রয়েছে। গ্রীসের সংবিধান অনুসারে ইস্টার্ণ অর্থডক্স চার্চ অফ ক্রাইষ্ট হল সেদেশের মূল ধর্ম। অর্থডক্স চার্চ অফ গ্রীস, প্রভু যীশুখ্রীষ্টকে তাঁদের প্রধান বলে স্বীকৃতি দেয়। কনস্ট্যান্টিনোপলের দ্য গ্রেট চার্চ অফ ক্রাইষ্ট এবং অন্যান্য গীর্জাগুলিও এই নিয়মকে মেনে চলে। 
গীর্জা থেকে রাষ্ট্রকে যেখানে আলাদা করা হয় না এবং ধর্ম ও রাষ্ট্র যেখানে একসঙ্গে থাকে সেটি কি গণতন্ত্র ?
আরএসএফ –এর সূচক অনুসারে শুধুমাত্র এই একটি বিতর্কিত বিষয়ই নয়, এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে। 
 
(ক্রমশ) 
 

Comments

Popular posts from this blog

মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

খাঁচার মধ্যে ভয়ে কাঁটা, বলির পাঁঠা