সংবাদ মাধ্যমের ভবিষ্যৎ হল ওয়েব নিউজ


Web News,

এবং তারপর  : ১৬/১১/২০১৯ : সংবাদ পত্র ও টেলিভিশনের নেশা কাটিয়ে খবর খুঁজতে সাধারণ মানুষ নিজের মোবাইল ফোনকেই  আঁকড়ে ধরছে; টিভি, রেডি ও বা সংবাদপত্রের চেয়ে নিজের মোবাইল ফোনকেই মানুষ বেশি বিশ্বাস করতে চাইছে। 
মানুষ, একটা সময়ে বিশ্বের খবর পেত রেডিওতে। রেডিও সেই সময় বিরাট বড় একটি জন সংযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। গান, নাটক, আবৃত্তি ছাড়াও আরো কত কত অনুষ্ঠানে ভরে থাকত দিনগুলো। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাষণ  শোনার জন্যে অল ইন্ডিয়া রেডিও খুলে মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত; তবে রেডিওতে খবর পাওয়া যেত  সীমিত। 

এরপর সংবাদ পত্রের আগমন, রেডিওর  যুগেও যে সংবাদ পত্র ছিল না, তা নয়, তবে সেগুলি ছিল বেশির ভাগ সাহিত্য নির্ভর। কিন্তু একটা সময় মানুষ যখন রেডিওতে আগ্রহ হারিয়ে সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করল, তখন ভিড় বাড়তে লাগল প্রিন্ট মিডিয়ায়, একের পর এক নতুন নতুন সংবাদপত্র বাজারে আসতে লাগল। যেখানে প্রতিটি খবর সাধারণ ভাষায় অনেক বিস্তারিতভাবে পাওয়া গেল, সঙ্গে ছবি;  খবরের কাগজের আবার আর একটা দিক ছিল, খবরের কাগজ পুরনো হয়ে গেলে সেই কাগজ কাজে লাগত ঠোঙা তৈরিতে এবং আসন হিসেবে। মাসের শেষে পুরোন  খবরের কাগজ বিক্রির চল শুরু হল, মাসের শেষে কাগজ বিক্রি করে টু পাইস এলে  সারা মাসের খবরের কাগজ কেনার খরচ নগন্য   হলেও মানুষের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফোটাত। 

এরপর চলে এল টেলিভিভিশন, গোটা ঘটনা আর ছাপার অক্ষরে নয়, ছবিগুলি আর ছাপার কালিতে নয়, বরং জ্যান্ত হয়ে হাজির হতে থাকল মানুষের কাছে। দেশের মানুষ তখন অনেকেই ছিল নিরক্ষর, তাই সহজেই সংবাদপত্রের মোহ  ত্যাগ করে মানুষ মশগুল হয়ে উঠল টেলিভিশনের পর্দায়। ভাবখানা এমন যেন যা দেখব সরাসরি দেখব। আসলে সংবাদপত্রে  যে খবর পাওয়া যেত তা ছিল আগের দিনের খবর, আর টেলিভিশন দেখাত একটু আগেই ঘটে যাওয়া খবরগুলো। আগেরদিনের ঘটনাগুলো পরের দিন সকালে পৌঁছে দিত সংবাদপত্র।অর্থাৎ সেগুলো হয়ে গেল বাসি খবর ; যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিকমত না থাকায়, কলকাতায় সংবাদপত্র পরের দিন ভোরবেলায় পৌঁছালেও জেলা শহর বা মফস্সলে তা পৌঁছাতো পরের দিন বিকেলে। 

এর ফলে ক্রমেই পিছু হঠতে শুরু করেছিল সংবাদ পত্র। তবু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েনি। যখন বাজারে সাদা কালো উঠে গিয়ে রঙ্গিন টেলিভিশন চলে এল,তখন প্রায় সব সংবাদপত্রই রঙ্গিন হয়ে গিয়েছিল বাজার ধরার দৌড়ে টিঁকে থাকতে। যেমন সংবাদ পত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় টিঁকে  থাকতে ছোট ট্র্যানজিস্টারের আদলে  বাজারে এসে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল রেডিও। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সেই ট্র্যানজিস্টার হয়ে উঠল শুধুমাত্র এফ এম চ্যানেল, যা কিনা শুধুমাত্র বিনোদন দিতে পারত । 

হঠাৎ করে লাগাম ছাড়া বিনোদনের  মাধ্যম হিসেবে এফএমকে পেয়ে মানুষ তাকেও জড়িয়ে ধরেছিল। রাতারাতি গানের শ্রোতা বৃদ্ধি  পেয়ে গিয়েছিল হাজার গুন্। কিন্তু বিশ্বের খবর তাতে পাওয়া গেল না; টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখার পর বর্ণময় গোটা বিশ্বে (বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে) কি হচ্ছে তা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল প্রাচ্যের মানুষ; প্রযুক্তির হাত ধরে এল কেবল টিভি সার্ভিস। ছাদের মাথায় এন্টেনা হারিয়ে  গেল, আর কাকেরা হারাল বসার জায়গা। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রযুক্তির হাত ধরে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে একের পর এক বিপ্লব, প্রযুক্তির নতুন ঢেউ আসতেই তাকে আঁকড়ে ধরেছে আপামর মানুষ আর একটু একটু করে ভুলে গিয়েছে পুরোন মাধ্যমগুলোকে। রেডিও চলে গিয়ে সংবাদপত্র, আর সংবাদ পাত্র চলে গিয়ে টেলিভিশন। তার মানে এই নয়, যে রেডিও বা টেলিভিশন একেবারেই ত্যাজ্য হয়ে গিয়েছে। রেডিও আজও  মানুষ শোনে, সংবাদপত্র আজও মানুষ পড়ে, টেলিভিশন আজও মানুষ দেখে, কিন্তু রেডিওর ক্ষেত্রে শ্রোতার সংখ্যা কমে গিয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা গিয়েছে অনেক কমে; পাশ্চাত্য দেশগুলিতে শুধু নয়, সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, পৃথিবীর বহু দেশেই  সংবাদপত্র কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যাঁরা বর্তমানে সংবাদপত্র বিক্রি করেন, তাঁরা পরিসংখ্যানটি আরও ভালোভাবে দিতে পারবেন। সেই তুলনায় টেলিভিশনের দর্শক অনেক বেড়েছে।
কিন্তু দিন আবার বদলাচ্ছে। এবার ক্রমেই টেলিভিশনের কপাল পুড়তে বসেছে, এখন নবাগত নায়কের নাম হল মোবাইল ফোন.; যার মাধ্যমে মানুষ যেকোনো মানুষের সাথে যখন তখন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, কথা বলতে পারে, অন্যকে  নিজের চোখে দেখতে পারে, তাকে বার্তা পাঠাতে পারে, সব সময় গোটা বিশ্ব উন্মুক্ত হাতের তালুর মধ্যে, পুরোন  বন্ধুকে খুঁজে নিয়ে ফের বন্ধুত্ব চালু করতে পারে। মোট কথা আক্ষরিক অর্থে গোটা দুনিয়াই  এখন হাতের 
মুঠোয়।

কিন্তু টেলিভিশনের খামতি তাহলে ঠিক কি ছিল ?  খামতি ছিল অনেক। প্রথমত, টিভি ছিল সেই মাধ্যম, যেখানে টিভিতে যা দেখাবে, তাই আমাকে দেখতে হবে, কিন্তু মোবাইল ফোনে আমি যা দেখতে চাইব, তাই আমি দেখব, অর্থাৎ মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে আমি অনেক বেশি স্বাধীন। দ্বিতীয় হল, টেলিভিশন ছিল পারিবারিক কিন্তু মোবাইল আমার একান্তভাবেই নিজস্ব, অর্থাৎ এতে কেউ ভাগ বসাবে না, আমি যদি এখন খেলা দেখতে চাই তাহলে খেলাই  দেখব পরিবারের অন্য সদস্যের জন্যে সিরিয়াল, বা সিনেমা কিংবা কার্টুন চালিয়ে রেখে দিতে হবে না; 
তাছাড়া মোবাইল ফোনে সুযোগ সুবিধে অনেক বেশি, যদিও মোবাইল ফোন এসে যাওয়ায় অন্য্ দিক থেকে মানুষের স্বাধীনতা কমেছে, যে কেউ যখন তখন আপনাকে ফোন করলেই পেয়ে যাবে ; তবু মানুষের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত থেকে সামাজিক থাকা, যেকোনো মুহূর্তের ছবি তুলে রেখে স্নরণীয় করে রাখা, গান শোনা, টেলিভিশন দেখা, সংবাদ পাওয়া ছাড়াও হাজারো কাজ যখন ছোট্ট একটি যন্ত্রে সুন্দরভাবে হয়ে যাচ্ছে, যা আমার মুঠোর মধ্যেই ধরা থাকছে, যার খরচ আমি অনায়াসেই মিটিয়ে দিতে পারছি, সেই বস্তু টি হাতে থাকলে মানসিক শান্তি লাভ করা যায় এটা মানুষ বুঝে গিয়েছে। আর বুঝে গিয়েছে বলেই বাজারে টেলিভিশনের বিক্রি একটু একটু করে কমতে চলেছে। 
টেলিভিশন তার  বাজার হয়ত এখনো বেশ কিছুদিন ধরে রাখতে পারবে, কিন্তু মোবাইল ফোনের এই প্রযুক্তির সাথে টিঁকে  থাকা বেশ কস্টকর, এটা বুঝে নিয়েছে টেলিভিশন প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও। তাই মোবাইল ফোনের পর্দা ছোট এই নেগেটিভ দিকটিকে তুলে ধরে বাজারে চলে এসেছে এমন টেলিভিশন যা কিনা মোবাইল ফোনের অনুষ্ঠানগুলিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখাবে। 

মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওয়েব চ্যানেলের চাহিদা বেড়েছে শত শত  গুন্। মানুষ চাইছে তার হাতে ধরে থাকা ছোট্ট যন্ত্রটিতে গোটা বিশ্বকে পুষে রাখতে। আজকের বাজারে তাই মোবাইল ফোনে ওয়েব নিউজের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাড়ছে প্রতিযোগিতাও ।  আর চার পাঁচ বছর পর এমন অবস্থা হবে যে, মানুষ টেলিভিশন থেকে মোবাইলের দিকে স্থায়ীভাবে মুখ ফেরাতে বাধ্য হবে; কেননা দ্রুত পরিবর্তনশীল মানুষের পছন্দ, রুচি ও ক্রয়  ক্ষমতার সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন নয়; মানুষ এখন যত তাড়াতাড়ি মোবাইল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, তত তাড়াতাড়ি টেলিভিশন কেনার সিদ্ধান্ত নেয় না;

মানুষ এখন খুব কমই সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখছে, মাঠে গিয়ে খেলা দেখছে, কোনো গানের আসরে গিয়ে গান শুনছে, এমনকি নিমন্ত্রণ করতে হলেও মানুষ ব্যবহার করছে মুঠোফোনকে, খাবার খেতে হলে, বেড়াতে যেতে হলে, সংবাদ পেতে হলে , অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা দিতে হলে, টর্চ  জ্বালাতে হলে, কোনো কিছু মনে করিয়ে দিতে হলে, হিসেবে কষতে হলে, তারিখ দেখতে হলে, তাপমাত্রা জানতে হলে, সিনেমা দেখতে হলে, গান শুনতে হলে, ডায়রি লিখতে হলে, চিঠি লিখতে হলে, গল্পের বই পড়তে হলে, নিজের ভাবা বেগ কারোর সাথে ভাগ করে নিতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাচ্ছে মুঠোফোনকে।
আজকের দুনিয়ায় সংবাদ মাধ্যমের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মুঠোফোনের ওপর. অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের ওপর প্রশাসনিক যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা নেই ওয়েব নিউজের ক্ষেত্রে  আর সে কারণেই ওয়েব নিউজ অনেক বেশি স্বাধীন। তাই সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে ওয়েব নিউজ হল ভবিষ্যৎ।


Comments

Popular posts from this blog

মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান এতো খারাপ কেন ? (পর্ব - ১)