নতুন আমেরিকাও কি ভারতের বন্ধু হয়ে উঠবে ?

নতুন আমেরিকাও  কি ভারতের বন্ধু হয়ে উঠবে ?
জো বাইডেন 


কেমন হতে পারে  নতুন 
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো  
বাইডেনের সাথে ভারতের 
সম্পর্ক ? ভারত কি কোন 
সমস্যায় পড়তে পারে ?
 আলোচনা করলেন 
সাংবাদিক অরিন্দম নন্দী

এবং তারপর, ০৯/১১/২০২০ :
নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রীতিমত ধরাশায়ী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কুরসী দখল করে নিলেন সেই দেশেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিগত দিনগুলিতে আমরা ক্রমাগত দেখে এসেছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সখ্যতার ফুটেজ। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে   প্রশ্ন জাগতে শুরু করে দিয়েছে, আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি কি ট্রাম্পের মত হবেন ?   তিনি কি আমাদের শত্রুদেশগুলিকেই সমর্থন করবেন ? বাইডেন নতুন রাস্ট্রপতি হয়ে   আসায় ভারতের কি কোনো সমস্যা  হতে পারে ?
  আসুন সবার আগে আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি সম্ভন্ধে একটু ভাল করে জেনে নেওয়া   যাক, একটু পরিচয় করে নেওয়া যাক। জো বাইডেন, পুরো নাম জোসেফ রবিনেট   বাইডেন। একটি ক্যাথলিক পরিবারে বাইডেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর   পেনসিলভিনিয়ার স্ক্র্যান্টনে। বাবার নামও ছিল জোসেফ বাইডেন, তাই পরিবারের বড়     ছেলেকে 'জুনিয়ার বাইডেন' বলে ডাকা হত।  বোনের নাম ভ্যালেরি আর দুই ভাইয়ের                                                   নাম ফ্র্যান্সিস এবং জেমস। 
সিনিয়ার বাইডেনের হাতে ভালোই পয়সা ছিল, কিন্তু জুনিয়ার যখন সবে জন্মেছে, তখন ব্যবসায় মন্দা দেখা দিল।  বেশ সঙ্কটের মুখে পড়লেন সিনিয়ার বাইডেন, পরিবার নিয়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়িতে থাকতে। তবু তিনি লড়াইটা  ছাড়েন নি, আর একজন সফল গাড়ি বিক্রেতা বা সেলসম্যান হয়ে মোটামুটি আর্থিক সচ্ছ্লতার সাথেই গোটা পরিবারকে নিয়ে  কাটিয়ে দিয়েছিলেন। জুনিয়ারের সামনে সবচেয়ে খারাপ দিনটা ছিল, যেদিন এক পথ দুর্ঘটনায় তার মা এবং বোন মারা গিয়েছিল। দুই ভাইও মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিল, তবু তারা বেঁচে গিয়েছিল। জুনিয়ার বাইডেন মা এবং বোনকে হারানোর যে ব্যাথা পেয়েছিল তা কোনোদিন পূরণ করে উঠতে পারে নি। 
ছোটবেলায় 


জো বাইডেন কবে যে কৈশোর পার করে লেখাপড়া শিখে যুবক হয়ে উঠলেন, তা তিনি নিজেই বোধ হয় টের পান নি।ছাত্রাবস্থায় স্কুলের ফুটবল টিম কিংবা বেসবল টিমের নেতৃত্ব দেওয়াই  হোক, অথবা স্কুল-কলেজের বন্ধুদের গ্রূপের নেতৃত্ব দেওয়াই হোক, নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল জো বাইডেনের মধ্যে। এই জন্যেই স্কুলেও তাঁকে ক্লাস প্রেসিডেন্ট হয়ে থাকতে হত চিরকাল। 
যে বাইডেন আদ্যপান্ত রাজনীতির মানুষ, নিজের দলকেও তিনি চিরকাল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। নিউ ক্যাসেল কাউন্টি কাউন্সিলের সদস্য, সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির দায়িত্ব, আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব, বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির দায়িত্ব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটরের  দায়িত্ব, ভাইস প্রেসিডেন্টের গুরু দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত সফলভাবে সামলে এসেছেন এতদিন ধরে, আর এবার দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেশবাসী দিয়েছেন তাঁরই কাঁধে। সেই দায়িত্বও সফলভাবে পালন করতে প্রস্তুত জো  বাইডেন। 
দীর্ঘদিন ধরেই হোয়াইট হাউসের সাথে সম্পর্ক জো বাইডেনের। রাষ্ট্রপতি ভবনের নাড়ি  নক্ষত্র তাঁর চেনা। খুব চেনা। তাঁকে অনেক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে হোয়াইট হাউসেরই অভ্যন্তরে। ট্রাম্পের মত মার্কিন মিডিয়াকে কখনোই চটান নি তিনি। তিনি জানেন কোনো কঠিন কাজ কিভাবে সহজে হাসিল করতে হয়। ট্রাম্প ছিলেন বেশ বদরাগী, কিন্তু বাইডেন হাসিখুশী মানুষ। মুখের হাসি দিয়ে অনেক কিছুকে জয় করতে জানেন তিনি। ট্রাম্প ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু বাইডেন আদ্যপান্ত রাজনীতিবীদ।রাজনীতি এবং কূটনীতি বেশ ভালোই বোঝেন তিনি। 
ট্রাম্প ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু। কিন্তু তাই বলে বাইডেনের সাথে মোদীর সম্পর্ক কখনই  খারাপ ছিল না। এখনও নেই। বাইডেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাথে সাথেই মোদী তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাইডেনের সাথে মোদীর সম্পর্ক নতুন নয়। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বাইডেন মার্কিনী ভারতীয়দের  সমর্থন চেয়ে এসেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি হয়ে যে তিনি ভারতের বন্ধু হয়ে উঠবেন এমন কথাও বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হয়েই তাই তিনি প্রচুর পরিমাণে ভারতীয়দের  নাগরিকত্ব বিলে সাক্ষর করবেন বলে জানিয়েও দিয়েছেন। 
মনে রাখতে হবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্প যে সব সমর্থন ভারতকে করে গিয়েছে সেই সময় ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনও সেগুলোকে প্রত্যক্ষ করে গিয়েছেন এবং সমর্থনও করে গিয়েছেন। ট্রাম্প চলে গিয়ে বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন বলেই আমেরিকা এবার পাকিস্তানকে সমর্থন করবে, এমন কথা নেই। বিশ্বের দরবারে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘর হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে। FATF  আজ না হলেও আর কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানকে ধূসর তালিকা থেকে কালো তালিকাভুক্ত করতেই পারে, সেটা বাইডেন বিলক্ষণ জানেন। তাই তিনি কোনোভাবেই পাকিস্তানকে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না। 
চীনের আগ্রাসন নীতি সম্পর্কে গোটা বিশ্ব ওয়াকিবহাল, তাই হঠাৎ করে চীনের প্রতি আমেরিকা তাদের নীতি বদলে ফেলবে সেটা সম্ভব নয়। ভারত-চীন ইস্যুতে আমেরিকা ভারতের পাশেই থাকবে সেটা পরিস্কার। তাছাড়া কূটনৈতিক ইস্যুতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ রয়েছে ভারতের পাশেই। চীন ইস্যুতে ভারতের পাশে রয়েছে আমেরিকাও। তাদের নৌবহর জাপান পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। সেখান থেকে রাতারাতি মুখ ঘুরিয়ে নীতি বদল করে নেবে আমেরিকা, এটা মনে হয় না। নীতিগতভাবেই চীনের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে না আমেরিকা। 
ভুলে গেলে চলবে না ২০০৮ সালে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের সেনেটর হিসেবে বাইডেন মার্কিন-ভারত সিভিল নিউক্লিয়ার  চুক্তি করেছিলেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারতকে চিরকালই বাইডেন আলাদা গুরুত্ত্ব দিয়ে এসেছেন। ২০১৩ সালে ২২ থেকে ২৫শে  জুলাই বাইডেন স্ত্রী জিলকে নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। সেই সময় ভারতের সাথে তাঁর আলাদাভাবে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাঁর সফরে তিনি দিল্লী এবং মুম্বইয়ে গিয়েছিলেন এবং মুম্বইয়ের শিল্পপতিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী আমেরিকায় গিয়েছিলেন, সেই সময় মোদীর সাথে তিনি মধ্যাহ্ন বোজ সেরেছিলেন। ২০১৬ সালে মোদীর সাথে একসাথে মহাসম্মেলন করেছিলেন জো  বাইডেন।  বারাক ওবামা যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট  ছিলেন, তখন বাইডেনের উদ্যোগেই ভারতকে আমেরিকা ডিফেন্স পার্টনার হিসেবে ঘোষণা করেছিল। বিশ্বের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার দৌড়ে ভারতরকে বার বার সমর্থন জানিয়ে এসেছেন জো বাইডেন। বাইডেন বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। ভারতের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন জো বাইডেন। সুতরাং আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিতে এবং কূটনীতিক বিষয়ে বাইডেনকে যে ভারত পাশে পাবে সেটা ভালভাবেই বোঝা যায়।
একটি অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, ভারত যখন বালাকোট সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছিল, তখন আমেরিকার স্যাটেলাইট ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করেছিল। ইজরায়েলের প্রযুক্তিও ব্যবহার করেছিল। আমেরিকার স্যাটেলাইট জানতে সাহায্য করেছিল বালাকোটের একটি বাড়ির মধ্যে থাকা ১৭৪ জন জঙ্গী নিধন হয়েছিল। কিন্তু এই বক্তব্য সরকারিভাবে কেউই স্বীকার করবে না। গত মাসের ২৭ বা ২৮ তারিখে আমেরিকার সাথে ভারতের একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, যার ফলে এবার থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি আমেরিকার স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে পারবে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের কি সেই বিষয়ে সমর্থন ছিল না ?

মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন 


এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান একসাথে নৌবাহিনীর যুদ্ধ্যাভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরেই যুদ্ধ্যাভ্যাস চালাবে আরব সাগরে। এভাবে মোট ২৮ পর্যায়ে এই চার দেশ যুদ্ধ্যাভ্যাস চালিয়ে যাবে। আমেরিকার সাথে এই মুহূর্তে ভারতের বন্ধুত্ব অনেক গভীরে শিকড় বাড়িয়ে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দুই দেশের বাণিজ্য, প্রযুক্তি, কূটনীতি, অর্থনৈতিক লেনদেন প্রায় সব কিছুতেই যে নৈকট্য দেখা যাচ্ছে, তা দুই দেশের কোনো দেশই  নষ্ট করতে চাইবে না। তাছাড়া যে বন্ধুত্ব ট্রাম্পের সাথে মোদী গড়ে তুলেছিলেন, হয়ত তার চেয়ে বেশি সখ্যতা বাইডেনের সাথেই গড়ে তুলবেন নরেন্দ্র মোদী। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামলা হ্যারিস একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাঁর আদি বাড়ি দক্ষিণ ভারতে। ভারতের সাথে আমেরিকার বন্ধুত্ত্বের বিষয়ে এই ব্যাপারটা যে একেবারেই কাজে লাগবে না, তা নয়। 

Comments

Popular posts from this blog

মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

খাঁচার মধ্যে ভয়ে কাঁটা, বলির পাঁঠা