ভোটের আগেবি যুযুধান দুই পক্ষের ইস্তাহার যুদ্ধ



ভোটের আগেবি যুযুধান দুই পক্ষের ইস্তাহার যুদ্ধ
লেখক : অরিন্দম নন্দী 
  এবং তারপর, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ২২/০৩/২০২১ : এবার পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা    নির্বাচনকে ঘিরে টান টান উত্তেজনার সাক্ষী থাকতে চলেছেন বঙ্গবাসী। দুই পক্ষের লড়াই এবার জমে উঠেছে। একদিকে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং আর একদিকে ভারতীয় জনতা পার্টী। তৃণমূল রাজ্যে তাদের শাসন ব্যবস্থা নিজেদের হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, উল্টোদিকে বাংলায় নিজেদের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে, নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি। যুযুধান দুই পক্ষের লড়াইয়ে কে জিতবে, বাংলায় পরিবর্তন হবে নাকি প্রত্যাবর্তন হবে সেটা দেখতে হলে ২রা মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ওই তারিখেই নির্বাচনের গণনা হবে এবং রাজ্যের জোড়া ফুল এবং পদ্মফুল শিবিরের ভাগ্য নির্ধারণ হবে।আর মাত্র ৪১ দিনের অপেক্ষা।


ভোটের আগেই তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে অবশ্য আরও একটা যুদ্ধ দেখা গেল। সেটা হল ইস্তেহারের যুদ্ধ। দুই রাজনৈতিক দলই নিজেদের ইস্তেহার প্রকাশ করে দিয়েছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল দুই রাজনৈতিক দলই  এবার তাদের ইস্তেহারে যে বিষয়গুলির ওপর বেশি গুরুত্ত্ব দিয়েছে, সেগুলি হল মহিলাদের সশক্তিকরন , ছাত্র-ছাত্রী এবং কৃষক। দুই দলই  এই বিষয়গুলির ওপর জোর দিচ্ছে কেন ?



বিজেপি তাদের ইস্তেহারে কর্মক্ষেত্রে বা চাকরির বিষয়ে মহিলাদের জন্যে সংরক্কন ৩৩% করার কথা বলেছে। পাল্টা তৃণমূলের তরফ থেকে জানা যাচ্ছে তারা পঞ্চায়েত স্তরে বা গ্রামে গঞ্জে মহিলাদের জন্যে ৫০% সংরক্ষন ইতিমধ্যেই রেখেছে। এই বিষয়টিকে নিয়েও প্রচারের ময়দানে বাকযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছে দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে। আগ বাড়িয়ে বিজেপি তাদের ইস্তেহারে বলে রেখেছে যে কোনো সরকারি বাসে মহিলারা বিনামূল্যে ভ্রমন করতে পারবেন। শুধু তাই নয় কেজি স্কুল থেকে শুরু করে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত মহিলাদের পড়াশুনা করতে আর টাকা খরচ করতে হবে না। এই জায়গায় তৃণমূল আবার স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড-এর ব্যবস্থা করতে চাইছে ১০ লক্ষ টাকা করে, যাতে সন্তানের পরাশুনার জন্যে বাবা বা মায়ের ওপর কোনো চাপ না পড়ে। তৃণমূল সরকার রাজ্যবাসীকে যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিয়েছে, তাও পরিবারের কোনো মহিলাদের নামে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু মহিলাদের ওপর এত গুরুত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন ?  রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দেশে মেয়েদের পড়াশুনার ওপর বেশি খরচ করতে বহু পরিবার অনীহা দেখায়। গ্রামে গঞ্জে এই ঘটনা বেশি ঘটে। এবার যদি সরকার তার পরাশুনার ভার নেয় তাহলে সেই পরিবারের সুবিধা হয়। এছাড়াও কোনো পরিবারের মহিলা তার পরিবারকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে। তাই সংসারে যদি মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়, তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে  ভোটবাক্সে।

এমনিতেই দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে লড়াই চলছেই। এই লড়াই হল বিজেপির আয়ুষ্মান ভারত বনাম তৃণমূলের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড-এর মধ্যে। কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প এ রাজ্যে বলবৎ করতে দেয়নি রাজ্য সরকার। বিজেপি জানিয়েছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে এর মধ্যেই ভুরি ভুরি অভিযোগ সামনে এসেছে, ভোটে জিতে বিজেপি সরকার গড়লে স্বাস্থ্য সাথী নয় আয়ুষ্মান ভারতের সুবিধা ভোগ করবেন রাজ্যবাসী। এই বিষয়টি নিয়েও ভোট প্রচারে ব্যাপক যুদ্ধ চলছে দুই পক্ষের মধ্যে। 

এরপর আসছে কৃষকদের জায়গাটা।  সবাই জানেন, পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছে। সেই আন্দোলনকে ধামা চাপা দিতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র সরকার। কিন্তু এই বিষয়টিকে নিয়ে আমাদের রাজ্যে এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রচার সেভাবে দেখা যায় নি বিপক্ষ দলের জনসভায়। এমনকি আমাদের রাজ্যে কৃষকতরাও আন্দোলনে সামিল হন নি। অর্থাৎ কৃষক আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েও তার রাজনীতিক ফায়দা তৃণমূল কংগ্রেস তুলতে পারে নি এখনো পর্যন্ত। তৃণমূলের জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হরিয়ানা অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন দুই একবার উল্লেখ করা ছাড়া সেভাবে জায়গা করতে পারে নি। উল্টোদিকে বিজেপি তাদের ইস্তেহারে জানিয়ে রেখেছে তার পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করলে লবন পাওয়া যাবে ৩ টাকা কিলো এবং চিনি পাওয়া যাবে মাত্র ৫ টাকায়। তবে তৃণমূল সরকার ঘোষণা করেছে, রাজ্যের সব মানুষ বিনা পয়সায় রেশন পাবেন, এবং সেই রেশন তাদর বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়া হবে। এই ধরনের কোনো অঙ্গীকার অবশ্য বিজেপি করে নি। 

কেন্দ্র সরকার কৃষক সন্মান নিধি প্রকল্পের আওতায় দেশের কৃষকদেরকে ৬০০০ টাকা করে ভাতা দিচ্ছে, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে চালু করতে দেন নি, পরিবর্তে রাজ্য সরকার কেন্দ্র সরকারের অনুরূপ প্রকল্প কৃষকদের দিতে চাইছে। কিন্তু বাংলার কৃষকরা যেহেতু তিন বার কেন্দ্রের এই অনুদান পান নি, সেইজন্যে তিনবারের মোট টাকা অর্থাৎ ১৮০০০ টাকা করে কৃষকদের দিতে চাইছে কেন্দ্র সরকার। বিজেপির ইস্তেহার বলছে ভোটে জিতে বিজেপি সরকারে গড়লে এই টাকা কৃষকদের দেওয়া হবে। অর্থাৎ এখানেও সেই কৃষক সম্প্রদায়কে খুশি করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজ্য কৃষিপ্রধান রাজ্য, তাই কৃষকরা খুশী হলে তার প্রভাব ভোটবাক্সে পড়তে বাধ্য, শুধু তাই নয়, বাংলার কৃষকদের খুশী করতে পারলে সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে হরিয়ানার আন্দোলনরত কৃষকদেরকেও।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মা ক্যান্টিন নামে একটি প্রকল্প নিয়েছেন, যেখানে সাধারণ মানুষ ৫ টাকায় মধ্যাহ্ন ভোজ করতে পারেন। সেখানে খাবারের মেনুতে থাকে ভাত, ডাল, সবজি ও ডিমের ঝোল। এবার ভোটে জিতে আসলে বিজেপি চালু করবে অন্নপূর্না ক্যান্টিন, বিজেপির ইস্তেহারে তেমনটাই বলা হয়েছে। এই ক্যান্টিনে সাধারণ মানুষ ৫ টাকায়  তিনবেলা পুষ্টিকর খাদ্য পাবেন। যদিও মেনুতে কি কি থাকবে তা বিজেপির পক্ষ থেকে জানা যায় নি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে খাওয়ানোর লড়াইতেও  চলছে সমানে সমানে টক্কর।

তবে দুই পক্ষের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা যাচ্ছে এই রাজ্যে সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট আইন বলবৎ করা নিয়ে। বিজেপির ইস্তেহার বলছে নির্বাচনে জিতে তারা এই রাজ্যে সিটিজেনস এমেন্ডমেন্ট আইন বলবৎ করতে চায়, যে আইনের প্রথম থেকে বিরোধীতা করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই জায়গাটা নিয়েই এব্বারের ভোটে টান টান উত্তেজনা। সিএএ-র সুবিধা বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পদ্ম শিবির আর এর কষ্টকর দিকটা তুলে ধরতে চাইছে জোড়াফুল শিবির। যদিও ইস্তেহারের ক্ষেত্রে যুযুধান দুই শিবিরই  দাবী করেছে যে তাদের ইস্তেহার মানুষের জন্যে, বাংলার উন্নয়নের জন্যে। কিন্তু কোন ইস্তেহার রাজ্যের মানুষ বেশি পছন্দ করবেন বা কোন রাজনৈতিক দলের ওপর তাঁরা বেশি ভরসা করবেন, সেটা জানতে হলে আমাদের ২রা মে তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। সেদিন রাজ্যের সাধারণ মানুষই জানিয়ে দেবেন কোন ইস্তেহার তাঁদের জন্যে বেশি উন্নয়ন নিয়ে আসবে। জনতা জনার্দন সেদিন রায় দেবেন কোন ফুলকে তাঁরা চয়ন করলেন বা নির্বাচিত করলেন, পদ্ম না কি জোড়া ফুল বা ঘাসফুল !







Comments

Popular posts from this blog

মৃত্যুর পরেও তানসেনের দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কে ?

হনুমানজী কি আজ বেঁচে আছেন ?

খাঁচার মধ্যে ভয়ে কাঁটা, বলির পাঁঠা